অস্তিত্ব

শরীরটা ভালো না থাকায় আজও কাজে যেতে পারলো না রহিমা বেগম। দুর্বল শরীর নিয়ে আপন কুটিরের বারান্দায় কাত হয়ে শুয়ে আছে। সকালে মনে হয়েছিল আজকের মধ্যে শরীরটা ভালো হয়ে যাবে কিন্তু রাত কাটানোর পর আজ আরো অবনতির দিকে যাবে তা বুঝতে পারেনি। বুঝতে পেরেও লাভ কি? আরোগ্য কামনায় একমাত্র আল্লাকে ডাকা ছাড়া কোনো পথ নেই। যুদ্ধের সময় একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে আজ পর্যন্ত এভাবেই জীবন সংগ্রাম চালিয়ে আসছে সে। একমাত্র ছেলে শফিকের কথা মনে হলে অশ্রু দমিয়ে রাখা বড়ই কষ্টকর হয়ে দাঁড়ায়। অবশ্য মির্জাবাড়ির কাজের মধ্যে থাকলে এসব ভুলে থাকার জন্য ভালো পরিবেশ পাওয়া যায়। কিন্তু দুই দিন শারীরিক অসুস্থতার কারণে কাজে যেতে না পারায় আপন কুটিরেই পড়ে থাকতে হচ্ছে। আর একা শুয়ে থাকা মানেই স্মৃতি রোমন্থনে ফেঁসে যাওয়া। ঠিক সেটাই ভোগ করতে হচ্ছে আজ দু'দিন।

করিম মির্জা আজ সকালে এসেছিলেন রহিমা বেগমের দু'দিন কাজে না যাওয়ার কারণ জানতে। রহিমা বেগম অসুস্থতার কথা বলে মির্জা সাহেবের মুখের দিকে তাকিয়ে ছিল। তার সেই চাহনীর মাঝে মিশে ছিল একটি প্রত্যাশা। মির্জা সাহেব হয়তো ওষুধ-পথ্যের কোনো আশ্বাস দিতে পারেন। রহিমা বেগমের এ প্রত্যাশাটা খুব বেশি অবান্তরও ছিল না। মির্জা সাহেব তাকে একটু বেশি পারিশ্রমিক দেন। আর সেই বেশিটুকুর জন্যই কোনো রকমে খেয়ে পেটটা চলে। তাছাড়া বৃদ্ধা হওয়ায় কোনোদিন কোনো জোরের কাজও তিনি করতে দেননি। এসব সহানুভূতির উপর ভর করেই রহিমা বেগম অব্যক্ত একটা প্রত্যাশার জাল বিছিয়েছিল চাহনীর মাঝে। করিম মির্জা রহিমা বেগমের চাহনীতে কোনো প্রকার বিচলিত বোধ না করেই বললেন, ঠিক আছে না পারলে কাজে যাওয়ার দরকার নেই। কথাটা বলেই তিনি চলে গেলেন।

করিম মির্জার কথায় খুশি হওয়ার মত কিছু খুঁজে পেল না রহিমা বেগম। নিজের অজান্তই দু'ফোটা অশ্রু এসে গালের দু'পাশে গড়িয়ে পড়লো। হয়তো জোর করেও সে অশ্রু দমিয়ে রাখা সম্ভব হতো না। এ সময় সন্তান হারানো যে কোনো বৃদ্ধা মাতার পক্ষে সন্তানের কথা ভুলে থাকাটা অসম্ভব। তাইতো এখন তার শুধুই মনে পড়ছে শফিকের কথা, শফিকের স্মৃতি জড়ানো দিনগুলোর কথা। মনে প্রশ্ন জাগে- সে সময় শফিককে অনুমতি দেওয়াটা কি ঠিক হয়েছিল? অনুমতি না দিলে শফিক কোনোদিন যুদ্ধে যেত না। মায়ের অবাধ্য হওয়ার মত ছেলে সে নয়। আর যেতে না দিলে হয়তো ওকে হারাতেও হতো না। আজ শফিক বেঁচে থাকলে এমন কষ্ট করতে হতো না। উপার্জন করার কেউ না থাকায় বৃদ্ধা বয়সে অন্যের বাড়িতে কাজ করতে যেতে হয়। কাজ না করলে পেটে অন্ন-পানি দেওয়াটা দুঃসাধ্য হয়ে যায়। কাজে যাওয়া হয় না সে কারণে ঘরে খাবার আসা বন্ধ হয়ে গেছে। আজ সকাল থেকে এই বিকেল পর্যন্ত না খাওয়া অবস্থায় শুয়ে থাকতে হয়েছে। মাঝে মাঝে মনে হয় ছেলেকে যুদ্ধে পাঠানোর সিন্ধান্তটা ভুল ছিল। আজ শফিক বেঁচে থাকলে এমন অনাহারে থেকে একাকী জীবন কাটাতে হতে না। নতুন একটা পরিবার হতো। ছেলে-বৌ এবং নাতী-পুতিদের নিয়ে গড়ে উঠতো সুন্দর সংসার। শফিকের মেয়ে পছন্দ করা ছিল। সে মেয়ে তারও খুব পছন্দ। সে প্রায়ই আসতো এ বাড়িতে। হেসে খেলে বেড়াত। সেও আজ কোথায় গেছে কে জানে।

হ্যাঁ ওকে যুদ্ধে যেতে দেয়াই ভুল হয়েছে। আবার মনে হয়- ভুল হবে কেনো? দেশের ঐ অবস্থায় ব্যক্তিকেন্দ্রিক ভাবাটাই ভুল হত। সমগ্র দেশকে নিয়ে ভাবা উচিত হয়েছে। একার স্বার্থে সুখ খোঁজা উচিত নয়। একটু ত্যাগের জন্য সমগ্র দেশের শান্তি নষ্ট হবে সেটা ভাবা উচিত না। শফিক বেঁচে আছে এই স্বাধীন দেশের মানুষের মাঝে, এই লাল-সবুজের পতাকা শফিককে সম্মান জানাচ্ছে। এটাই বড় পাওয়া।

ভাবতে ভাবতে আরও কিছুক্ষণ কেটে গেল। সময় যত পার হচ্ছে তত ক্ষুধার প্রবণতা বাড়ে। এদিকে ঘরে কিছু নেই। থাকার কথাও নয়। সামান্য পারিশ্রমিকে ক'দিনই বা চালানো যায়। এমন সময় মাথার কাছে কার যেন পায়ের শব্দ শোনা গেল। দেখার জন্য ফিরে তাকালো। একটি মহিলা ও একটি ছেলে এসে দাঁড়িয়েছে। শাড়ি দিয়ে চোখের পানি মুছে ওদের চেনার চেষ্টা করেও চিনতে পারলো না। কিছু বলার আগেই মহিলাটা বললো- "কেমন আছো খালা? রহিমা বেগম অবাক হলো কথাটা শুনে। তাঁকে খোঁজ নেয়ার কোনো লোক আছে এ কথা ভাবতেই পারে না। আজ কে এলো? কোথা থেকে এলো? রহিমা বেগম কোনো কথা না বলে ঐ মহিলার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। অনেকটা চেনা চেনা মনে হচ্ছে। কণ্ঠটাও পরিচিত বলে মনে হয়েছে। নিজের উপর চাপানো প্রশ্নের কথা ভুলে গিয়ে বললো- "তুমি কে মা?" মহিলাটি আস্তে করে রহিমা বেগমের পাশে বসে বললো- “খালা আমাকে চিনতে পারছো না? আমি শিরিন?"
-"শিরিন"! চমকে উঠে বললো রহিমা বেগম। তৎক্ষণাৎ তার স্নেহমাখা হাতখানা মহিলার উপর তুলে দিল। সেই সাথে তার চোখদুটোও অশ্রু বিসর্জন দিতে থাকলো। কাঁদো কাঁদো গলায় বললো- "মা শিরিন, তুই এখন কোথায় থাকিস? এতদিন আসিসনি কেন?"
- "এখন আমি অনেক দূরের মানুষ খালা। মনে করলেই তো আসা যায় না।”
- "আগে যে আসতি"!
- "তখন আমার পরিচয় ছিল অন্যরকম আর এখন অন্যরকম। এখন ইচ্ছে থাকলেও আমি আসতে পারি না।
এমন সময় পাশ থেকে ছেলেটা বললো- "আম্মু এই বুড়িটা কাঁদছে কেনো?"
রহিমা বেগম ছেলেটার দিকে তাকিয়ে বললো- "ছেলেটা কে?"
- "আমার চেলে"। মাথা নিচু করে কথাটা বললো শিরিন। রহিমা বেগম ভুলেই গিয়েছিল শিরিনের পরিচয় পাল্টে গেছে। আগের সেই শিরিন নেই। থাকবে কী করে? শফিক তো নেই। রহিমা বেগম আবার অতীতে ফিরে আপন ভাবনায় ডুবে গেল। এই সেই শিরিন যাকে তার শফিক ভালোবাসতো। শিরিনও শফিককে গভীরভাবে ভালোবাসতো। সেই সুবাদে শিরিনের তরফ থেকে শ্রদ্ধার একটা অংশ পড়তো রহিমা বেগমের প্রতি। এখানে এসে তাকে দেখাশুনা করতো। ওদের দুজনের সম্পর্কের কথা তার জানা ছিল। কিন্তু ওদের বুঝতে দিত না। একদিন ওদের আলাপকালে সে উপস্থিত হলে কী লজ্জাইনা পেয়েছিল শিরিন। তার পর থেকে সামনে এসে লজ্জায় ভালোভাবে কথা বলতে পারতো না। পরিকল্পনা ছিল শফিকের পড়া শেষ হলে ওদের বিয়ে দিয়ে দেবে। কিন্তু তা আর হলো না। ওদের বিয়ে হলে অমন একটি ছেলে হত। সে ছেলে তাকে বুড়ি বলতো না। সে চোখের পানি মুছে দিয়ে বলতো দাদী কেঁদো না। এতক্ষণের নীরবতা ভেঙ্গে শিরিন বলল-
- "কি ভাবছো খালা?"
- "ভাবনার কি শেষ আছেরে শিরিন! তোর কি মনে পড়ে আগের সেই দিনগুলোর কথা?”
- "পড়বে না কেন, ওসব কি আমি কোনদিন ভুলতে পারবো? আমি যতদিন বাঁচবো ততদিন কোনোভাবেই ভুলতে পারবো না।"
- "কত আশা ছিল তোকে বউ করে ঘরে তুলবো। তুই আমার হৃদয়ে যে আসন তৈরি করে নিয়েছিস তা আর কেউ করতে পারবে না।"
- "আমারও তো ইচ্ছে ছিল তোমাদের কাছে একজন হওয়া কিন্তু নিয়তি তো হতে দিল না। থাক সেসব কথা। এসব মনে করলে কষ্ট আরো বাড়বে। তার চেয়ে এখনকার কোনো কথা বলো। তোমাকে এখন কে দেখাশুনা করছে?"
- "তুই আর শফিক ছাড়া আমাকে আর কেউ কোনোদিন দেখাশুনা করেছে নাকি?"
- "তার মানে! তোমার এই মুমুর্ষ অবস্থায়ও প্রতিবেশী বা অন্য কেউ তোমার পাশে আসে না?
- "কার এমন দায় পড়েছে যে এই বুড়িকে দেখাশুনা করবে, খেতে দেবে? মির্জাবাড়ি কাজ করি আর খাই, এভাবেই চলে।"
- " এই অবস্থায় তুমি কাজ করতে যাও! তোমার কাজ করার মত বয়স কোথায়? শফিক ভাই মুক্তিযোদ্ধা ছিল। শুনেছি এখন নাকি মুক্তিযোদ্ধা বা তার পরিবারকে ভাতা দেয়া হয়। তুমি তাদের কাছে বলে.....।"
- "তোর মত অনেকে বলেছে তাই করতে, কিন্তু আমি রাজি হইনি। আমি এভাবে কিছু নিতে পারবো না। আমার শফিক জীবন দিয়েছে দেশের জন্য, মানুষের মঙ্গলের জন্য। এর বিনিময়ে আমি কিছু নিতে চাই না। তাছাড়া আমি এই সম্মানকে সামান্য কার্ড বা সার্টিফিকেট নামক কাগজে সীমাবদ্ধ করতে চাই না। আমি এই স্বাধীন দেশে যেদিকে তাকাই সেদিকেই আমার শফিকের অস্তিত্ব খুঁজে পাই।
- "তাই বলে তুমি এভাবে কষ্ট করবে? তোমার চেহারা দেখে মনে হচ্ছে পেটে ক্ষুধা আছে, সকাল থেকে কিছু খেয়েছো?"
- "অনেক দিন পর আজ তোকে দেখে আমার বড় ধরনের ক্ষুধা পূরণ হয়ে গেছে। যে ক্ষুধা আমি ছাড়া আর কেউ অনুভব করতে পারবে না। তোর সাথে আমি যেন শফিককেও দেখতে পাচ্ছি। আর কি ক্ষুধা থাকতে পারে?”
রহিমা বেগমের অবস্থা দেখে শিরিনের ইচ্ছে হচ্ছে কিছুদিন তার পাশে থাকতে। কিন্তু তা সম্ভব নয়। মন চাইলেও তার পরিবার সেটা মেনে নেবে না। অনেকক্ষণ ধরে শিরিনের ছেলের উপর রহিমা বেগমের দৃষ্টি পড়ে আছে। হঠাৎ কানে এল- "এই শাহীন আম্মুকে ডেকে দে" সকলেই সে কথা শুনে রাস্তার দিকে তাকালো। ছেলেটা বললো- "আম্মু চলো, ভাইয়া ডাকছে"। শিরিন রাস্তার দিকে একনজর তাকিয়ে আবার রহিমা বেগমের দিকে ফিরলো। তারপর ব্যাগ থেকে কিছু টাকা বের করে বললো-
-"খালা, আমার আর থাকা সম্ভব হচ্ছে না। বড় ছেলেটা ডাকতে এসেছে। তুমি এই টাকাগুলো রাখ। যা প্রয়োজন হয় এটা দিয়ে কিনে নিও"।
-"আমাকে করুণা করছিস মা?"
-"খালা তুমি একথা বলতে পারলে! তুমি আমার আপন কেউ ভাবো না?
-"পর ভাবলাম কবে?"
-"তবে এ কথা বললে কেন? শফিক ভাই থাকলে তোমার এই অবস্থা হতো না। আমাকে অন্যের ঘরনী হতে হত না, তোমার কাছেই থাকতাম। তখন কি এটা ফিরিয়ে দিতে পারতে? তোমাকে কি করে বুঝাবো- আমি দূরে থাকলেও তোমার কথা আমি ভুলে থাকতে পারি না। তুমি এই টাকাগুলো না নিলে আমি খুব কষ্ট পাব।"
কথাটা শেষ করে শিরিন টাকাগুলো রহিমা বেগমের হাতের মধ্যে গুজে দিল। তারপর কিছুক্ষণ তার মুখের দিকে চেয়ে সালাম করে বললো- “খালা আমি চলে যাচ্ছি। আমার জন্য দোয়া করো। তারপর ছেলেটির হাত ধরে আস্তে আস্তে রাস্তার দিকে হেঁটে যাচ্ছে আর বার বার পিছনের দিকে তাকাচ্ছে। রহিমা বেগম একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল শিরিনের চলে যাওয়া পথের দিকে। শিরিনের ঐ ফিরে দেখা চাহনী রহিমা বেগমকে অন্যরকম করে দিচ্ছে। শিরিনের ওই চাহনী, ওই চলনভঙ্গীর মাঝে মিশে আছে তার সাজানো অতীত। শিরিনের দিকে তাকিয়ে সে যেন স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে শফিকের স্মৃতি, শফিকের অস্তিত্ব। শিরিনের সবকিছু মনে করিয়ে দেয় পিছনের কথা। হারানো দিনগুলোর কথা। দেখতে দেখতে শিরিন অনেকদূরে চলে গেছে। রহিমা বেগমের চোখদুটি ছল ছল করছে। ধীরে ধীরে অশ্রু এসে দৃষ্টিকে ঝাপসা থেকে আরো ঝাপসা করে দিচ্ছে। একসময় সেই ঝাঁপসা দৃষ্টির মাঝে শিরিন হারিয়ে গেল। আর তাকে চেনা যাচ্ছে না।

(রচনাকাল: নভেম্বর-২০০৪)