বিনিয়োগ (অণুগল্প)

দহলিজ ঘরের দেয়াল ঘড়িটার দিকে আরেকবার তাকায় কাসেম আলী। ঘড়ির কাটাটা আরো কিছুটা পথ পাড়ি দিয়েছে। মোড়লবাড়ির কাজের লোক বলেছিল, “এখানে বসেন, কিছুক্ষণের মধ্যে মোড়ল সাহেব আসছেন”। পনের মিনিট পার হয়ে গেল, এখনো তিনি আসলেন না।

অপেক্ষমান কাসেম আলী পেশায় ভ্যান চালক। তিন ছেলে-মেয়ের পড়াশুনার খরচ যুগিয়ে কোনোমতে সংসার চলে। এরই মধ্যে নতুন এক সমস্যায় পড়েছে সে। বেশ কিছুদিন ধরে পেটের মধ্যে ব্যথা করছিল। ব্যাপারটা তার স্ত্রী রহিমাকেও জানায়। ব্যথাটা ধীরে ধীরে আরো তীব্র হতে থাকে। স্ত্রীর জোরাজুরিতে ডাক্তার দেখিয়ে পরীক্ষা করিয়ে জানতে পারে এপিন্ডিক্স হয়েছে। ডাক্তার বলেছে, খুব দ্রুত অপারেশন করা দরকার। অপারেশনটা জরুরী হলেও টাকার অভাবে সেটা এখনও করা হয়নি। গত ক’দিন যাবৎ সে ভ্যান নিয়ে বের হতেও পারেনি। ফলে একমাত্র উপার্জনের পথটাও আপাতত বন্ধ হয়ে আছে। তার পরিচিত আরেক ভ্যানচালক রহমত আলী তাকে সিরাজ মোড়লের শরণাপন্ন হতে পরামর্শ দেয়। সে বলেছিল “সিরাজ মোড়ল মানুষকে সাহায্য করে শুনেছি, উনার কাছে গেলে একটা উপায় হয়ে যাবে”। তার কথা মতই আজ সে মোড়লের কাছে এসেছে।

দহলিজ ঘরের সামনে কাজের লোকটার হঠাৎ কাজে মনোযোগী হওয়ার চেষ্টা দেখে কাসেম আলী বুঝতে পারে এবার মোড়ল সাহেব আসছেন। মনিবকে দেখলে কাজের লোকদের কাজের ধারা পাল্টে যায়। হ্যাঁ, তিনি আসলেন। ঘরের মধ্যে ঢুকে কাসেম আলীর সামনের বড় চেয়ারটাতে বসতে বসতে তার আগমনের কারণ জানতে চাইলেন। কাসেম আলী বিনয়ের সাথে কথাগুলো জানায়। কথাগুলো শোনার পর মোড়ল কিছুক্ষণ চুপ থাকলেন। তারপর বললেন, “আমি মানুষকে সাহায্য করার চেষ্টা করি, তবে সেটা তো সবসময় সম্ভব হয় না। তুমি গত মাসে আসলে দিতে পারতাম। রমজান মাস ছিল, খুব ভালো সময়। আমি মানুষকে যা দেয়ার তখন দিয়েছি, তোমাকেও দিতে পারতাম। আগামী বছরও রমজান মাসে দেব”। কাসেম আলী জানায় সে এখন বিপদে পড়েছে বলেই এখন এসেছে। রমজান মাসে সে সুস্থ ছিল। তাছাড়া বিপদ-আপদ তো সময়-সুযোগ বুঝে আসে না। তার কথাগুলো শোনার পরও মোড়ল সাহেব এ সময় সাহায্য করতে পারবেন না বলে জানালেন।

শেষমেশ কাসেম আলীকে নিরাশ হয়ে বেরিয়ে আসতে হলো। বড় রাস্তায় উঠে আনমনে ভাবতে থাকে, রমজান মাসেই তার দান করার কারণ কী? এমন তো নয় যে ঐ সময় তিনি বেশি টাকা আয় করেন। হঠাৎ কাসেম আলীর মনে পড়লো, একসময় সে মসজিদে ইমাম সাহেবের মুখে শুনেছিল, রমজান মাসে দান করলে সত্তর গুণ বেশি সওয়াব পাওয়া যায়। কাসেম আলীর ভাবনা গভীর হতে থাকে। তার মনে পড়ে, তার এলাকায় এক লোক সারাবছর খাদ্য গুদামজাত করে রাখে। বছরের যে সময়টাতে দাম বাড়ে তখন বাজারে ছাড়ে। এই মূহুর্তে ঐ লোকটার সাথে মোড়লের খুব বেশি পার্থক্য পায় না কাসেম আলী। সে ভাবতে থাকে মোড়লের এ দান কি আসলেই দান নাকি অধিক লভ্যাংশের জন্য বিনিয়োগ?